ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানুষ অনেক যুগ ধরেই ভাবছে আমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য কী? কেউ বলে, জীবন মানে শুধু আনন্দ করা, খাওয়া দাওয়া আর ভোগ বিলাসে সময় কাটানো। আবার কেউ মনে করে, বেশি বেশি টাকা পয়সা, জমি জমা আর সম্পদ অর্জন করাই জীবনের আসল লক্ষ্য। অন্যদিকে কেউ কেউ বলে, শুধু পড়াশোনা করে জ্ঞান অর্জন করাই জীবনের মূল উদ্দেশ্য।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
কিন্তু ইসলাম ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছে, ইসলাম খুব স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, মানুষ কোনভাবেই উদ্দেশ্যহীন ভাবে সৃষ্টি হয়নি। আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন একটি বড় দায়িত্ব এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে, সে উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তাআঠিয়েছেন একটি বড় দায়িত্ব এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে, সে উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তালার এবাদত করা, সৎ পথে চলা, এমন ভাবে জীবন যাপন করা, যাতে মানুষ দুনিয়াতেও ভালো থাকে এবং আখেরাতেও সফল হয়।

পেজ সূচিপত্রঃ ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য

কুরআনে আল্লাহ বলেছেনঃ আমি জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। (সূরা আয যারিয়াত ৫৬)
এই আয়াত আমাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে মানুষ কোনো উদ্দেশ্যহীনভাবে দুনিয়ায় আসেনি। তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত করা। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কিন্তু ইবাদত শুধু নামাজ বা রোজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং যে কোনো ভালো কাজ, যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়, সেটাই ইবাদত।
অনেকেই মনে করেন ইবাদত মানে কেবল মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া বা রোজা রাখা। আসলে ইসলাম ইবাদতের ধারণাকে অনেক বড় করে দিয়েছে। একজন মানুষ যদি হালাল উপায়ে উপার্জন করে, পরিবারের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে, অসহায় ও দরিদ্রকে সাহায্য করে, প্রতিবেশীর হক আদায় করে তাহলে এগুলোও আল্লাহর কাছে ইবাদত হিসেবে গৃহীত হয়। কারণ এসব কাজ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী করা হচ্ছে।

ইবাদতের আসল অর্থ হলো আল্লাহর আনুগত্য করা এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য জীবন যাপন করা। তাই যদি একজন মুসলমান প্রতিটি কাজে আল্লাহর খুশি পাওয়ার নিয়ত রাখে, তবে তার পুরো জীবনটাই ইবাদতে রূপ নেয়। এভাবে ইসলাম আমাদের শিখায় মানুষের প্রতিটি সৎ কাজ আসলে ইবাদতের অংশ, যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়।

দুনিয়ার জীবন একটি পরীক্ষা

ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, দুনিয়ার জীবন হলো একটি পরীক্ষা। মানুষকে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, যাতে দেখা যায় সে আল্লাহর আদেশ মানে নাকি না। আল্লাহ চান মানুষ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সৎভাবে জীবন যাপন করুক এবং অন্যায়ের পথে না হাটুক। জীবনের প্রতিটি কাজ ছোট, বড়, ঘরে বা বাইরে করা এসবই এই পরীক্ষার অংশ। আমরা প্রতিদিন যেভাবে আচরণ করি, কথাবার্তা বলি, অন্যের সাথে ব্যবহার করি, সবই আল্লাহর কাছে হিসাবের জন্য। তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই আমাদের পরীক্ষার একটি সুযোগ।

যে মানুষ এই পরীক্ষায় সৎভাবে চলতে পারে, সত্যবাদী হয়, ন্যায়ের পথে থাকে এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতি দেখায়, তার জন্য আল্লাহ পুরস্কার রেখেছেন জান্নাতের আকারে। অন্যদিকে, যে মানুষ এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়, অন্যায় পথে চলে, মিথ্যা বলে বা অন্যের ক্ষতি করে, তার জন্য আছে জাহান্নামের শাস্তি। এই পরীক্ষায় সফল হওয়া, সফলতা মানে শুধু দুনিয়ায় ভালো থাকা নয়, বরং আখিরাতের জন্যও প্রস্তুতি নেওয়া।
মানুষ যদি সত্যবাদী হয়, অন্যের হক ঠিকমতো দেয়, দরিদ্র ও অসহায়কে সাহায্য করে, দয়া ও সহানুভূতি দেখায় এবং অন্যায় থেকে দূরে থাকে,  তবে সে সত্যিই সৎ জীবন যাপন করছে। ইসলাম শেখায়, সৎ জীবন যাপন করাই জীবনের একটি প্রধান উদ্দেশ্য, কারণ সৎ জীবন মানুষকে আল্লাহর কাছে প্রিয় করে, মানুষকে সম্মান দেয় এবং সমাজকেও সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ রাখে। একজন মুসলিম যদি তার জীবনকে এইভাবে পরিচালনা করে, তবে সে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গাতেই সফল হবে।

দুনিয়া ও আখিরাতের প্রস্তুতি

মানুষের জীবনের লক্ষ্য কেবল দুনিয়ায় ভালো থাকা নয়। ইসলাম বলে, আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজ দুনিয়া ও আখিরাত দুই জায়গার জন্যই প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ। দুনিয়ায় আমরা আমাদের পরিবার, শিক্ষা, চাকরি এবং সমাজের দায়িত্ব পালন করি। এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা মানুষকে দুনিয়াতে সম্মান ও সুখ দেয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
একই সঙ্গে মানুষকে আখিরাতের জন্যও প্রস্তুতি নিতে হয়। আখিরাত হলো চিরস্থায়ী জীবন, যেখানে আমাদের কাজের ফলাফলের বিচার হবে। তাই নামাজ পড়া, রোজা রাখা, যাকাত দেওয়া, অন্যায় ছেড়ে সৎ পথে চলা এসব আমাদের আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করে। যে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাত উভয়কেই মাথায় রেখে জীবন কাটায়, সে প্রকৃত সফল হয়।

সুতরাং একজন মুসলমানকে জীবনকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে সাজাতে হবে। দুনিয়ায় যে কোনো কাজ করলে, সেটা যেন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হয় এবং আখিরাতের জন্যও উপকারী হয়। জীবনকে এমনভাবে পরিচালনা করলে, আমরা দুনিয়াতেও শান্তি ও মর্যাদা পাই এবং আখিরাতেও মুক্তি ও জান্নাতের আশ্বাস পাই। এটি মানব জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব ও জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার।

ইসলামে জ্ঞান অর্জনের অনেক গুরুত্ব আছে। কুরআনের প্রথম আয়াতেই বলা হয়েছে (ইকরা অর্থাৎ পড়ো) মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টি এবং এই পৃথিবীর নানা বিষয় বুঝতে সাহায্য করে জ্ঞান। তাই একজন মুসলিমের জন্য জ্ঞান শেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু ইসলাম শেখায়, জ্ঞান শুধু দুনিয়ার চাকরি বা ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য নয়। জ্ঞান অর্জন করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানুষের উপকারের জন্য। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, একজন মুসলিমকে জ্ঞান দিয়ে তার জীবন ও সমাজকে সুন্দর ও সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে।
জ্ঞান শুধু অর্জন করলেই হবে না; তা সঠিকভাবে ব্যবহার করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একজন মুসলিমের উচিত তার জ্ঞানকে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, সত্য প্রচার এবং মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা। যদি জ্ঞান অন্যায় কাজে ব্যবহার করা হয়, তবে তা জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করতে সাহায্য করে না।

সমাজে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা

ইসলাম শান্তির ধর্ম। মুসলিম মানে হলো যে ব্যক্তি শান্তি দেয় এবং অন্যকে শান্তি উপভোগ করতে সাহায্য করে। একজন মুসলিমের জীবন কেবল নিজের ভালো থাকার জন্য নয়, বরং তার দায়িত্ব হলো আশেপাশের মানুষের শান্তি নিশ্চিত করা। এটি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের একটি অংশ।

সমাজে ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা একজন মুসলিমের বড় লক্ষ্য। কুরআনে আল্লাহ বলেছেনঃ তোমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করো, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে যায়। (সূরা নিসা ১৩৫) এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা মানুষের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ন্যায়বিচার ছাড়া সমাজে সত্যিকারের শান্তি সম্ভব নয়। তাই একজন মুসলিমকে সবসময় অন্যায়ের পথ থেকে দূরে থাকতে হবে এবং ন্যায়ের পক্ষে কাজ করতে হবে। এতে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সব জায়গায় শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকে।

মানবকল্যাণে অবদান ধৈর্য ও ত্যাগ স্বীকার

মানুষ একা থাকে না। সে পরিবার, সমাজ এবং দেশের সঙ্গে মিলে জীবন কাটায়। তাই একজন মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো অন্যদের উপকার করা।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
মানুষের জীবন সবসময় সহজ হয় না। জীবনে নানা ধরণের সমস্যা, কষ্ট ও পরীক্ষা আসে। ইসলাম শেখায়, এই কষ্টের সময় ধৈর্য ধারণ করাই সফলতার মূল চাবিকাঠি। একজন মুসলিমের কাজ হলো প্রতিটি কষ্টের সময় ধৈর্য রাখা এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করা।

ত্যাগ স্বীকার করাও মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কখনো কখনো অন্যের কল্যাণের জন্য নিজের কিছু ত্যাগ করতে হয়। ইসলাম এই ধরনের ত্যাগকে প্রশংসা করেছে। তাই একজন মুসলিমের উদ্দেশ্য হলো অন্যের উপকারে জীবন ব্যয় করা, ধৈর্য ধরা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

আত্মশুদ্ধি ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা 

মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা। আমাদের হৃদয় খারাপ চিন্তা, অহংকার, হিংসা, লোভ ও অন্যায় থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ইসলাম শেখায় যে নিজের মন ও চরিত্রকে সৎ ও পবিত্র রাখা খুব জরুরি। আত্মশুদ্ধি ছাড়া মানুষ প্রকৃতভাবে সফল হতে পারে না।
মানুষের জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো ইসলামী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ইসলাম বলে, সব মুসলমান একে অপরের ভাই। তাই জাতি, বর্ণ, ভাষা বা অর্থের পার্থক্য নয়, বরং ঈমানের ভিত্তিতেই ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য, ভালোবাসা এবং সাহায্যপ্রবণতা প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দুনিয়ায় খলিফাদের দায়িত্ব

ইসলাম মানুষকে কেবল ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেনি। আল্লাহ মানুষকে খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। খলিফা হওয়ার অর্থ হলো আল্লাহর নির্দেশ ও বিধান অনুযায়ী পৃথিবী পরিচালনা করা। একজন মুসলিমের দায়িত্ব হলো তার জীবন এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে আল্লাহর রেজা পূর্ণ হয়।

মানুষের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো পৃথিবীকে ন্যায় ও শান্তির মাধ্যমে পরিচালনা করা। আমাদের উচিত আল্লাহর সৃষ্টি ধ্বংস না করা, পরিবেশ ও জীবজগত রক্ষা করা, এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। এভাবেই একজন মুসলিম তার খলিফার দায়িত্ব পালন করতে পারে।

শেষ কথা

সবশেষে বলা যায়, ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনের উদ্দেশ্য খুব বিস্তৃত ও পূর্ণাঙ্গ। এটি কেবল ইবাদতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর মধ্যে আছে সৎ জীবন, জ্ঞানার্জন, সমাজকল্যাণ, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, আত্মশুদ্ধি এবং মানবতার সেবা। যদি মানুষ এ উদ্দেশ্যগুলো পূরণ করতে পারে, তবে সে দুনিয়ায়ও সফল হবে এবং আখিরাতেও মুক্তি পাবে। ইসলামের দৃষ্টিতেই এটাই মানব জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য।

আমার এই আর্টিকেলটি পড়ে যদি আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন। এবং আপনাদের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বারী বিডি আইটি র নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url