ছাত্র জীবনে মোবাইল ফোনের অপকারিতা
বর্তমান বিশ্বে মোবাইল ফোন মানুষের জীবনে এক অপরিহার্য যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মোবাইলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা, ব্যবসা, যোগাযোগ কিংবা বিনোদন সব ক্ষেত্রেই মোবাইল ফোন আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলেছে। তবে সব কিছুর যেমন সুফল আছে, তেমনি কুফলও রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদের জীবনে মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্রজীবন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে পড়াশোনা, জ্ঞানার্জন, নৈতিক শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু মোবাইল ফোনের অপব্যবহার অনেক সময় সেই প্রস্তুতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নিচে আমরা ধাপে ধাপে ছাত্র জীবনে মোবাইল ফোনের প্রধান অপকারিতাগুলো আলোচনা করব....।
পেজ সূচিপত্র
ছাত্রদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করা। কিন্তু হাতে মোবাইল থাকলে মনোযোগ রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব ভিডিও, অনলাইন গেম কিংবা চ্যাটিং এসবের প্রতি আকর্ষণ ছাত্রদের পড়াশোনা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এর ফলে পরীক্ষার প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ থেকে যায় এবং শিক্ষার মানও নষ্ট হয়..।
সময় জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ছাত্রজীবনে প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানো অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু মোবাইল ফোন এমন এক মাধ্যম যা অজান্তেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় গ্রাস করে নেয়। অনেক ছাত্র টিকটক, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা অনলাইন গেমে ডুবে গিয়ে পড়াশোনার সময় নষ্ট করে। একবার সময় নষ্ট হয়ে গেলে তা আর ফিরে আসে না, ফলে তারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে..।
দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম চোখের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল করে এবং চোখে জ্বালা পোড়া সৃষ্টি করে। তাছাড়া, রাতে মোবাইল ব্যবহার করার ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, যা শরীর ও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট করে। দীর্ঘমেয়াদে মাথাব্যথা, ঘাড় ও কোমরের ব্যথা এবং স্থূলতার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে উদ্বেগ, হতাশা এবং একাকীত্ব বাড়ে..।
মোবাইল ফোনের কারণে ছাত্ররা বাস্তব জীবনের সম্পর্ক থেকে অনেক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর পরিবর্তে তারা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডুবে থাকে। এর ফলে বাস্তব জীবনের যোগাযোগ দক্ষতা কমে যায়, আত্মবিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সামাজিকভাবে সক্রিয় হওয়ার প্রবণতা কমে যায়..।
মোবাইল ফোনে থাকা বিভিন্ন অ্যাপ ও গেম এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে ব্যবহারকারী আসক্ত হয়ে পড়ে। ছাত্ররা একবার মোবাইল আসক্ত হয়ে গেলে পড়াশোনায় আগ্রহ হারায়। প্রতিনিয়ত মোবাইল চেক করার অভ্যাস তৈরি হয়, যা তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই আসক্তি মাদকাসক্তির মতো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে..।
ইন্টারনেটে অসংখ্য তথ্য পাওয়া যায়, তবে সব তথ্য সত্য নয়। অনেক সময় ছাত্ররা ভুয়া খবর, গুজব বা বিভ্রান্তিকর তথ্য বিশ্বাস করে ফেলে। এতে তাদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হওয়ার বদলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তাছাড়া অশ্লীল কনটেন্ট বা অনৈতিক তথ্য তাদের নৈতিক চরিত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে..।
মোবাইল ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক ছাত্র অতিরিক্ত টাকা খরচ করে ফেলে। ডাটা প্যাক, গেম ক্রয়, প্রিমিয়াম অ্যাপস, বা অনলাইন সাবস্ক্রিপশন কিনতে গিয়ে তারা অপ্রয়োজনীয় খরচ করে। অনেক সময় এ ধরনের খরচ পরিবারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। ছাত্রজীবনে সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে ওঠার বদলে অপচয়ের প্রবণতা বাড়ে..।
মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় ছাত্ররা অনেক সময় না বুঝেই ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করে ফেলে। এতে তারা প্রতারণা, হ্যাকিং, বা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে পারে। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগও অনেক সময় জীবনের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। তাই সচেতনতা ছাড়া মোবাইল ব্যবহার করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ..।
অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার ছাত্রদের নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অনেকেই অশ্লীল কনটেন্টে আসক্ত হয়ে পড়ে, যা মানসিকভাবে তাদের দুর্বল করে তোলে। নৈতিক মূল্যবোধ কমে যায় এবং তারা সহজে ভুল পথে পা বাড়াতে পারে। এর ফলে জীবনের সঠিক দিকনির্দেশনা হারিয়ে যায়..।
আরও পড়ুন খরগোশের অপকারিতা:
মোবাইল ফোনে আসক্ত ছাত্ররা পড়াশোনায় নিয়মিত হতে পারে না। অনেক সময় ক্লাস ফাঁকি দেয়, হোমওয়ার্ক অসম্পূর্ণ থাকে এবং পরীক্ষার প্রস্তুতিও দুর্বল হয়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়াশোনার মান কমিয়ে দেয়। ফলে তারা জীবনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়..।
ছাত্রদের জন্য সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও একাগ্রতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি তাদের মনোযোগ বিভক্ত করে দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে ভিডিও দেখা বা গেম খেলার কারণে তাদের চিন্তাশক্তি দুর্বল হয় এবং নতুন কিছু সৃষ্টির ক্ষমতা কমে যায়..।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে ছাত্ররা অন্যদের জীবনযাত্রার সাথে নিজের জীবন তুলনা করে। এতে হীনমন্যতা, হতাশা ও মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। লাইক, কমেন্ট বা ফলোয়ার না পেলে তারা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, যা পড়াশোনা ও ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে..।
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অনেক সময় ছাত্ররা বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। অপরিচিত লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব, অনলাইন প্রতারণা, বা অশালীন কথোপকথন তাদের জীবনকে বিপজ্জনক পথে ঠেলে দিতে পারে। এছাড়া অনলাইন গেমিংয়ে অর্থ খরচের কারণে তারা অপরাধের দিকেও ঝুঁকতে পারে..।
ছাত্র জীবনে মোবাইল ফোনের কুফল এড়াতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- পড়াশোনার সময় মোবাইল ব্যবহার না করা।
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের বেশি মোবাইল ব্যবহার না করা।
- শুধুমাত্র শিক্ষামূলক কাজের জন্য মোবাইল ব্যবহার করা।
- পরিবারের সদস্য ও শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা।
- অপ্রয়োজনীয় অ্যাপস ও গেমস মোবাইল থেকে সরিয়ে ফেলা।
মোবাইল ফোন আধুনিক যুগের এক অসাধারণ আবিষ্কার হলেও এর অপব্যবহার ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে ছাত্রজীবনে মোবাইল ফোনের অপকারিতা শিক্ষাজীবনকে বাধাগ্রস্ত করে এবং জীবনের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ করে তোলে। তাই ছাত্রদের উচিত মোবাইল ফোনকে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় ও ইতিবাচক কাজে ব্যবহার করা।অভিভাবক ও শিক্ষকদের দায়িত্ব হলো ছাত্রদের মোবাইল ব্যবহারে সচেতন করা এবং সময়ের সঠিক ব্যবহার শেখানো। যদি মোবাইল ফোনকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে এটি শিক্ষার সহায়ক শক্তি হবে; আর অপব্যবহার করলে এটি ছাত্রদের জীবন ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াবে..।
বারী বিডি আইটি র নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url